কবিতা 

গুচ্ছ কবিতা ।। পূর্ণিমা নকরেক

চুনিয়ার মেয়ে -১

চোখ খুঁজে পায় শাদা, আকাশি বই
ছুঁই ছুঁই
আকাশের রং…
দক্ষিণের জানালায় ফুটে না ফুল
লতানো পাতা গজায় প্রেমের শেষ পৃষ্ঠায়

কানে এসে ফিসফিস করে লাল বাতি আমাকে জ্বালাও
চকচক প্রেমভরা বাতিঘর
প্রেমিকেরা রাঙায় কবির কবিতায়…

 

চুনিয়ার মেয়ে – ২

বারান্দায় পড়ে আছে দীক্ষাভরা চু।
আমার পাতাঝরা বনে জোছনা দেখার গভীররাতে
আমি বেছে নিয়েছি নাগরিক নিদ্রাহীন বন্দিত্ব।
এখানে বারান্দাও বড্ড একা, ওখানে বনের ধারে আমার উঠোন জমজমাট।

মাকড়সা হয়তো বাসা বেঁধেছে আমার পানপাত্রে
কয়োনি, দিজনী, মেজনী
আদি কথার অবসরে তাঁদের সারিকে হারানোর
ব্যথা ভরে রাখে চুয়ের পাত্রে
আমিও স্বপ্নযাত্রায় তাঁদের পাত্রে উঁকি দিয়ে আসি।

কখনো নিঝুম কখনো ঝাপসা তারা
কখনো বৃষ্টি কখনো অসম্ভব আমাবস্যা আর জোছনায়
জেগে থাকে আদিগন্তবিস্তৃত আমাদের আদিবাসী গ্রাম।

আমি নেই বলে উঠোনে কী শূন্যতা রবে না একটুও?

 

চুনিয়ার মেয়ে – ৩

বাসের চাপায় আমি যেন মরীচিকা দেখি
নিজে চাকা হয়ে ঘুরি যেদিন থেকে
সেদিন থেকেই রক্ত ঝরছে, মৃত্যুর উৎকট গন্ধ পাচ্ছি আমি
বাজে সাতটা, কাঁদে জাতটা, শুনেছি কেবল নিজেরই আত্মার কান্না
সিগনাল থামিয়ে দেয় বার বার পথিকের পা
উলঙ্গ পাগলা বাবা তো থামে না
তার হাঁটা পথটিতে নেই শালবৃক্ষের ঝরা পাতা
অনাশ্রয়ী নাগরিক এই আমি চেয়ে দেখি
পথের ধারে তার ঘুমিয়ে থাকা
প্রাণ আছে কী তার, নাকি জানা নেই প্রাণ এবং প্রাণহীনতার ব্যবধান

 

চুনিয়ার মেয়ে – ৪

নাগরিক ক্লান্তিতে তোমার স্পর্শের স্মৃতি আমাকে জাগায়
গভীর রাতে এক ফোঁটা শান্তি হয়ে জাগাতে তুমি
ও গো আমার ঘুম জাগানিয়া চু
তোমাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে রাখার দিনগুলো নেই আর।

নগরের রাস্তাঘাটে শুধু শুনি অচেনা কাকের ডাক
বার বার ছুটে যাই আমার শালবনের ধারে,
ভোরের পাখির ডাক বুকের ভেতরে হাহাকার করে ডাকে।

শহরের চাঁদ বড় দেয়ালে আটকে আহত-রক্তাক্ত,
তুমি যে আমার বনের ধারের বাড়ি বারান্দায় নেমে আসা বড় চাঁদ নও
সেটা কী বুঝবে এই নগর ভবনের দেয়াল?
শুধু বুঝে আমার শালবনের ঝরাপাতা,
আমার উঠানে ফেলে আসা প্রেমিক হৃদয়।

ভোর হলেই এই শহরে পাখির কিচিরমিচির কুহু-কুহুতান
হয়ে যায় বাসের হর্ন, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।
আমি ভীষণ অসম্ভবের টানে ছুটে যাই আমার গাঁয়ের পথে
তৃষ্ণায় ফাটে বুক, ও আমার ভোরের আলো আরও দাও প্রাণ।

 

চুনিয়ার মেয়ে – ৫

নগর ছেড়ে যাচ্ছি বহু দূরে…
শালবনে গভীর মনে
হারিয়ে যাবো পাতায় পাতায়
খুঁজে নিও আমায় শালবৃক্ষের মায়ায়
শালের পাতা হয়ে ঝরে ঝরে মাটির সাথে মিশে যাবে আমার দেহ
আমাকে খুঁজতে হলে যেও মধুপুরে খুঁজে নিও শালবনের ঝরা পাতায়…

 

চুনিয়ার মেয়ে – ৬

নগরে দকমান্দা পরে হেঁটে যাওয়া মানেই
পথের প্রেমিককে উসকে দেওয়া
তাদের দৃষ্টিতে আহত হই রোজ
তবু দকমান্দা গায়ে চুনিয়াকে ডেকে আনি—
এই নাগরিক কোলাহলে।
ওরা বলে আল্লা, আমি ডাকি ঈশ্বর
মাঝেমধ্যে আমার মনে আসে —
সাংসারেক ঈশ্বর নকগুবার নাম
আমি জানি বিধাতা একজন
তাকে আমি বহুরূপে পাই আপন সত্তায়
গাঁয়ের মতো আমি স্বাধীন নই,
পরাধীন আমার দকমান্দা
দেহ—মনে বেজে ওঠে বেদনার বাঁশি
মনে পড়ে পাতা ঝরা শালবন
রোজ কথা বলি বাংলায়—
আমার সকাল শুরু হয় বাংলায়
রাত নামে বাংলায় —
তবু আমি বাঙালি নয়—মনে জাগে সাংসারেক টান
যখন ইচ্ছে হয় প্রবল আত্মবিশ্বাসে
আমার আচিক—মান্দি ভাষায় বলি
ফ্রিংনাম, ওয়ালনাম।

 

চুনিয়ার মেয়ে – ৭

শাল পাতা ঝরবে ঝরবে বলে শেষ পাতার রং খেলছে
গ্রামে ঘরে ঘরে সবার উঠানে ফুলের মেলা দুলছে
কেউ হারবে না, কারোর উঠান
ফুটাবেই মল্লিকারি ফুল এই শীতের সকালে…
সাজবে গাইবে গ্রামের ছোট ছোট্ট সোনারা
ফুলের গন্ধে ভরে যায় আমার ছোট গ্রামটি
বনের হরিণ শীতে দৌড়াচ্ছে
মাঝেমধ্যে আমার উঠান দিয়ে
ছুটে যাওয়ার পায়ের ছাপে আমি মাতোয়ারা ছিলাম
মনে পড়ছে বার বার এই শহরের যানজটে
কোথাও নাইরে বাঁধনহারা পাখির ডানা
শুধু আছে এই নগরে কাকের বাসা
কখন যাবো যাবো বলে সকালের ফুলের সুগন্ধ খুঁজি
হঠাৎ বাসে উঠে যাবো আমার ছোট্ট গ্রামে

Related posts